খিলাফত আন্দোলন – ১৯১৯ সাল – Khilafat movement

  • ‘খিলাফত ’ শব্দটি খলিফা ( Calipha ) শব্দের সঙ্গে সংযুক্ত । ‘খলিফা ’ — এই শব্দটির অর্থ হল উত্তরাধিকারী । ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে নবি হজরত মহম্মদ মারা যাওয়ার পর মদিনাতে হজরত আবুবকর খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হলে খিলাফত আদর্শের সূচনা ঘটে । আব্বাসীয় বংশের পতন ঘটার পর তুর্কিরা রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করলে তুর্কি সুলতান মুসলমানদের ‘ খলিফা ’ ( ধর্মগুরু ) হিসেবে পরিচিতি পান । তত্ত্বগত দিক থেকে এই খলিফা ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষদের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক নেতা । বিংশ শতকে এই তুরস্কের সুলতান একাধারে ছিলেন অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের প্রধান এবং সমগ্র মুসলিম জগতের ধর্মগুরু ।
  • প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তুরস্ক জার্মানির পক্ষ নেয় ও ইংল্যান্ডের বিরােধিতা করে। এই যুদ্ধে ইংল্যান্ডের কাছে জার্মানির পরাজয়ে খলিফারও পরাজয় ঘটে । যুদ্ধ শেষে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে 'ভার্সাই শান্তি সমাবেশে' বিভিন্ন পরাজিত দেশের সঙ্গে মোট পাঁচটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল । মিত্রপক্ষ তুরস্কের ওপর নানা অপমানজনক সন্ধির শর্ত চাপিয়ে দেয় এবং তুরস্কের সুলতান অপমানিত ও সিংহাসনচ্যুত হন । এতে বিশ্বের মুসলিম সমাজ ক্ষুব্ধ হয়। ভারতীয় মুসলিম সমাজ আশা করেছিলেন, মিত্রপক্ষের অন্যতম শক্তি ব্রিটিশ অন্তত তুরস্কের প্রতি সুবিচার করে মুসলিমদের স্বার্থরক্ষা করবেন ।
  • তুরস্কের সুলতান তথা খলিফাকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে তাঁরা বিশ্বজোড়া আন্দোলন গড়ে তোলেন । ইতিহাসে এই আন্দোলন খিলাফৎ আন্দোলন নামে পরিচিত ।
  • ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় খিলাফৎ প্রশ্নকে সমর্থন করে ভারতে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ করেন । খিলাফৎ আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসাবে আলি ভ্রাতৃদ্বয় অর্থাৎ মৌলানা মহম্মদ আলি ও সওকৎ আলির উদ্যোগে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ১৭ ই অক্টোবর 'খিলাফৎ দিবস' পালিত হয় এবং ঐ বছরই 'নিখিল ভারত খিলাফৎ কমিটি' গঠন করেন । এই কমিটির প্রধান প্রধান দাবি ছিল—
    • খলিফার সাম্রাজ্য অক্ষুন্ন রাখতে হবে।
    • খলিফার পার্থিব ও ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ করা চলবে না।
    • পবিত্র মক্কা-মদিনার ওপর বিদেশি রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বন্ধ রাখতে হবে।
    • বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখা।
  • এই আন্দোলনের প্রধান নেতৃবর্গের মধ্যে ছিলেন – আলী ভ্রাতৃদ্বয় মুহম্মদ আলী ও শওকত আলী, আবুল কালাম আজাদ, ড. এম.এ আনসারী ও হসরত মোহানী।
  • উত্তর ভারতের বেশ কয়েকটি শহরে খিলাফত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং বোম্বাই শহরে একটি কেন্দ্রীয় খিলাফত কমিটি গঠিত হয়। শেঠ ছোটানী নামীয় এক ধনী ব্যবসায়ীকে এ কমিটির সভাপতি ও মওলানা শওকত আলীকে সম্পাদক করা হয়। এই কমিটির সদস্যগণ খিলাফৎ প্রশ্নের সম্মান জনক মিমাংসা না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম অব্যাহত রাখার সংকল্প ব্যক্ত করেন ।
  • বালগঙ্গাধর তিলক ও গান্ধিজি উভয়েই খিলাফৎ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন । গান্ধিজি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে মুসলিমদের ন্যায় সংগত দাবি মেনে নিতে ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করেন । অন্যথায় তিনি সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার কথা ব্যক্ত করেন ।
  • ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে দিল্লিতে গান্ধিজির সভাপতিত্বে সর্বভারতীয় খিলাফৎ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । এই সম্মেলনে হিন্দু ও মুসলিম নেতৃবৃন্দ যৌথভাবে খিলাফৎ আন্দোলন চালিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন । সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাব একই সঙ্গে নিখিল ভারত খিলাফৎ কমিটি এবং জাতীয় কংগ্রেসে অনুমোদিত হয় । এভাবে খিলাফৎ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভারতে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলনের সূচনা হয় । ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে খিলাফৎ আন্দোলনকে তার সঙ্গে যুক্ত করা হয় ।
  • ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে আতাতুর্ক কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হলে খিলাফৎ আন্দোলন স্থিমিত হয়ে যায় ।